৩১. দেবীর রূপবর্ণনসুন্দর বদন, জিনিয়া মদন,চন্দ্রমার কলা, করে নানা খেলা,ললাট জিনিয়া সুধাকরে।তাহার উপরে, ঝলমল করে,সিন্দুর নলকে, বিদ্যুৎ ঝলকে,রচিত অরুণাস্বরে।।কিবা সে কবরী, বান্ধে থরথরি,তাহাতে সুন্দর, পুষ্প মনোহর,তার মাঝে দোলে জটা।কত কত ফণী, শিরে শোভে মণি,অনন্ত যেমন, দেখিয়ে তেমন,শিরে শোভা করে ঘটা।।গলে রত্নমাল, দেখিয়া বিশাল,সঙ্গে সহচরী, নাচে ফিরি ফিরি,প্রেত-ভূতগণ যত।সেবকের তরে, প্রতি ঘরে ঘরে,যত ভূতগণ, আনন্দিত মন,নভে ফিরে কত শত।।সেবক রাখিয়া, বেড়ায় চাহিয়া,লয়ে দলবল, দানব সকল,খাইছে সিদ্ধির পাতা।সেই দানাগণ, রক্ষে অনুক্ষণ,সেবকের পুরী, রাখে ফিরি ফিরি,ভাঙ্গয়ে দুষ্টের মাথা।।কাশী কহে ভাই, আর নাহি চাই,এই দানাগণ, পাই দরশন,তবে নাহি ইহা পর।যাঁর বশ গৌরী, আর ত্রিপুরারি,দানা প্রেত ভূত, তাহাতে পূরিত,হরগৌরী মাত্র সার।।৩২. ইন্দ্র কর্ত্তৃক গৌরীর স্তব ও শাপমুক্তিএইত কহিল পূজা বিধান যেমতে।ভূত প্রেত দানা খেলে সেবকের হিতে।।শ্রদ্ধা করি পূজে ইন্দ্র করিয়া কামনা।ভবানী পূজহ লোক, খণ্ডিবে যন্ত্রণা।।দুঃখবিনাশিনী মাতা হরের ঘরণী।মোরে কৃপা কর মাতা জগৎ-জননী।।দুর্গতি নাশনী মাতা করুণাদায়িনী।অনাথ-রক্ষিতা মাতা শুভ প্রদায়িনী।।জগতজননী মাতা দুঃখবিনাশিনী।বারেক করুণা কর গিরির নন্দিনী।।অসুর সংহার মাতা কৈলে অবহেলে।শুম্ভ নিশুম্ভ মারি রাখিলে সুরকুলে।।স্বর্গ-মর্ত্ত্য পাতালে করয়ে তব পূজা।আমার নিস্তার কর দেবী দশভূজা।।হরি ব্রহ্মাশিব তোমা ধ্যায় নিরন্তর।তোমার সেবনে হয় নিরাপদ নর।।কেবল গঙ্গার জল আর বিল্বপাতা।ইহাতে সন্তোষ বড় জগতের মাতা।।কেবল মানস সেবা কায়মনে করে।কভু নাহি ছাড় মাতা তাহার মন্দিরে।।এই মত স্তব করে দেব পুরন্দর।শচী ইন্দ্র দুই জনে করি যোড় কর।।বিস্তর স্তবন যদি কৈল সুরপতি।তুষ্ট হয়ে মহামায়া শুনি স্তুতি নতি।।অধিষ্ঠাতা হৈলা তবে জগতের মাতা।বর লহ দেবরাজ, কহে এই কথা।।লাজে ইন্দ্র হেঁটমুখ না কহে কথন।ভবানী দেখিল তবে ইন্দ্র লজ্জা-মন।।তবে ত শঙ্করপ্রিয়া বলিলা ইন্দ্রেরে।সহস্র লোচন হৌক তোমার শরীরে।।দেবীবরে সহস্র যোনি সহস্র লোচন।ভবানীর বরে ইন্দ্র সন্তুষ্ট তখন।।অষ্টমী করিলে ব্রহ্মহত্যা পাপ হরে।দেবীবরে ইন্দ্র সহস্রাক্ষ নাম ধরে।।অষ্টমী তিথির কথা কহনে না যায়।ভবানী সন্তোষ সদা থাকেন তাহায়।।অষ্টমী-মাহাত্ম্য কথা যেই জন শুনে।আয়ু যশ পুণ্য তার বাড়ে দিনে দিনে।।যাহার শ্রবণে খণ্ডে ভবাব্ধি বন্ধন।সেবহ দেবীর পদ করিয়া যতন।।পৃথিবীতে পঞ্চ ব্রত করে যেই জন।কদাচিত অমঙ্গল না হয় কখন।।এই ত কহিনু ইন্দ্র-শাপের মোচন।ইহার শ্রবণে লোক হয় ধর্ম্ম-মন।।৩৩. চন্দ্র কর্ত্তৃক গুরুপত্নী হরণ ও বুধের জন্ম বৃত্তান্তএইত কহিল পূজা বিধান যেমতে।ভীষ্ম বলিলেন, রাজা করহ শ্রবণ।আর কিছু ব্রতকথা কহিব এখন।।চান্দ্রায়ণ মহাব্রত বিখ্যাত সংসারে।শ্রদ্ধা ভক্তি করি ব্রত যে জন আচরে।।সর্ব্বকাম ফল লভে নাহিক সংশয়।পূর্ব্বে করিয়াছি আমি এ সব নির্ণয়।।ইতিহাস কহি এবে শুন দিয়া মন।চন্দ্রকেতু রাজা ছিল ইক্ষবাকু নন্দন।।চন্দ্রের নন্দিনী সেই পতিব্রতা সতী।চন্দ্রাবতী নামে কন্যা তাহার যুবতী।।শাপ হেতু জন্ম নিল নীলধ্বজ-ঘরে।চন্দ্রবতী নাম হৈল বিখ্যাত সংসারে।।এত শুনি জিজ্ঞাসেন ধর্ম্মের নন্দন।কহ শুনি পিতামহ ইহার কারণ।।চন্দ্রের কন্যারে শাপ দল কোন জন।মর্ত্ত্যলোকে জন্মে সেই কিসের কারণ।।ভীষ্ম বলিলেন, রাজা কর অবধান।পড়িবারে যায় চন্দ্র বৃহস্পতি-স্থান।।সর্ব্বশাস্ত্রে সিদ্ধ দ্বিজ-অঙ্গিরা-তনয়।নানা শাস্ত্র চন্দ্রেরে পড়ান অতিশয়।।ব্যাকরণ শ্রুতি স্মৃতি আদি শাস্ত্রগণ।কতদিন জীবস্থানে করিল পঠন।।জীবের রমণী সেই তারকা নামেতে।মোহিত হইল চন্দ্র তাহার রূপেতে।।কামে বশ হয়ে গুরুপত্নী না মানিল।প্রবন্ধ মায়ায় তারে হরিয়া লইল।।সত্যলোক স্থানে শুনি এ সব কথন।গুরুপত্নী সুধাকর করিল হরণ।।ক্রুদ্ধ হয়ে গেল গুরু চন্দ্রের সদন।বলিল, পাপিষ্ঠ তুই বড়ই দুর্জ্জন।।বৃথা শাস্ত্র মম স্থানে করিলি পঠন।গুরুপত্নী হরি পাপ করিলি অর্জ্জন।।কলঙ্কিত হও আজি হৈতে অমরায়।কলঙ্কী চন্দ্রমা বলি কহুক তোমায়।।আর এক বাক্য মম শুনরে অধম।মম শাপে মর্ত্ত্যলোকে হইবে জনম।।কুরুবংশে ধনঞ্জয় পাণ্ডুর কুমার।তাহার ঔরসে জন্ম হইবে তোমার।।কৃষ্ণের ভাগিনা হবে সুভদ্রা গর্ভেতে।অল্পদিনে শাপমুক্ত হইবে তাহাতে।।এত শুনি চন্দ্র তবে হৈল ক্রুদ্ধমন।গুরুরে শাপিল মহাক্রোধে সেইক্ষণ।।নিজবশ নহে আত্মা পরবশ হয়।জানিয়া আমারে শাপ দিলে মহাশয়।।তোমারে ত আমি শাপ দিব সে কারণ।হীন পক্ষিযোনি-মদ্যে লভিবে জনম।।গৃধ্র নামে পক্ষী তুমি অবশ্য হইবে।দীর্ঘদিন ভোগ ভুঞ্জি শাপে মুক্ত হবে।।ইহা শুনি জিজ্ঞাসেন ধর্ম্ম নরপতি।কিরূপেতে পক্ষিযোনি পায় বৃহস্পতি।।কত দিন গতে হৈল শাপ বিমোচন।কহ শুনি পিতামহ সব বিবরণ।।গাঙ্গেয় বলেন, ভূপ করহ শ্রবণ।চন্দ্রের বচন কভু না হয় খণ্ডণ।।গৃধ্র পতঙ্গেতে জন্ম হৈল বৃহস্পতি।বৃন্দারক গিরিতটে করিল বসতি।।পরম কৌতুক রহে ভার্য্যার সংহতি।কত দিনে বিহঙ্গিণী হৈল গর্ভবতী।।চারিগুটি ডিম্ব কত দিনে প্রসবিল।ডিম্ব ফুটি চারি শিশু তাহাতে জন্মিল।।দুই গুটি পুত্র হৈল দুই গুটি সুতা।স্বামী সহ বিহঙ্গিনী হৈল আনন্দিতা।।সর্ব্বাঙ্গসুন্দর শিশু দেখি চারি জন।বাৎসল্য করিয়া দোঁহে করয়ে পালন।।ক্ষণেক না ছাড়ে দোঁহে শিশুর সংহতি।নানা উপহার ভোগে পালে নিতি নিতি।।এইরূপে কত দিন আনন্দ কৌতুকে।ভার্য্যা পুত্রসহ পক্ষী বঞ্চে নানা সুখে।।একদিন দৈববশে আহার কারণে।একেশ্বর পক্ষিবর যায় ঘোর বনে।।ভার্য্যাকে রাখিয়া ঘরে শিশুর রক্ষণে।আহার কারণে গেল দণ্ডক কাননে।।হেনকালে এক ব্যাধ আসিল সে স্থান।পক্ষীরে দেখিয়া অস্ত্র করিল সন্ধান।।অল্পমাত্র অস্ত্রক্ষত হইল শরীরে।উড়িয়া পড়িল পক্ষী রেবানদী-তীরে।।শূন্য এক দেবালয় ছিল সেই স্থলে।তাহার ভিতরে গেল, ক্ষতে অঙ্গ জ্বলে।।পশ্চাতে দেখিল ব্যাধ আসিল সত্বর।শীঘ্রগতি পাশে দেবালয়ের ভিতর।।বাণেতে পীড়িত পক্ষী উড়িবারে নারে।ফিরি ফিরি ভ্রমে পক্ষী ধরিতে না পারে।।সাতবার প্রদক্ষিণ করে দেবালয়।তবে মহাক্রুদ্ধ ব্যাধ হৈল অতিশয়।।পুনরপি দিব্য অস্ত্র করিল প্রহার।বাণাঘাতে তনু ত্যাগ হিইল তাহার।।পক্ষী লয়ে গৃহে ব্যাধ গেল হৃষ্টচিত্তে।বিষ্ণু প্রদক্ষিণ ফল লভিল তাহাতে।।সেই পুণ্যে শাপে মুক্ত হৈল সেইক্ষণ।দিব্যমূর্ত্তি ধরি চলে বৈকুণ্ঠ-ভুবন।।যাহা জিজ্ঞাসিলে রাজা কহিনু তোমারে।গুরুশিষ্যে দোঁহে শাপ দিলেন দোঁহারে।।গর্ভবতী ভার্য্যা তবে দেখি বৃহস্পতি।ক্রুদ্ধচিত্তে তার প্রতি বলে মহামতি।।অবলা স্ত্রীজাতি তুমি কি বলিব আর।মম বাক্যে এই গর্ভ করহ সংহার।।তবে সে লইব তোমা আপন ভবনে।শীঘ্রগতি গভী ত্যাগ কর এইক্ষণে।।ভয়েতে আকুল প্রসবিল সেইক্ষণ।এক গুটি সুতা হৈল, একটী নন্দন।।দেখি হরষিত হবে কহেন তখন।মম কন্যা পুত্র এই বিধির সৃজন।।চন্দ্র বলে, মম পুত্র কন্যা এ হইল।আমার ঔরসে জন্ম জানয়ে সকল।।কথায় কথায় দ্বন্দ্ব করে দুই জন।জানিয়া সকল তত্ত্ব দেব পদ্মাসন।।শীঘ্রগতি সেই স্থলে করিয়া গমন।দ্বন্দ্ব নিবারণ হেতু কহেন বচন।।আমার বচনে দ্বন্দ্ব কর নিবারণ।কন্যা পুত্রদ্বয়ে জিজ্ঞাসহ বিবরণ।।যাহার ঔরসে জন্ম কহিবে কাহিনী।এত শুনি জিজ্ঞাসা করেন নিশামণি।।কাহার ঔরসে জন্ম নিলে দুই জন।মিথ্যা না কহিবে, সত্য কহিবে বচন।।নন্দিনী কহিল, দেব কর অবধান।যার ক্ষেত্র তার পুত্র শাস্ত্রের বিধান।।এত শুনি ক্রোধ করি বলে শশধর।মম শাপে নরলোকে হও লোকান্তর।।নরলোকে জন্ম গিয়া লভহ আপনি।নীলধ্বজ ঔরসেতে জন্মিবে নন্দিনী।।সেইক্ষণে লোকান্তর হইল তাহার।তবে চন্দ্র জিজ্ঞাসিল চাহিয়া কুমার।।কহ সত্য, জন্ম তব কাহার ঔরসে।মিথ্যা না কহিবে, সত্য কহিবে বিশেষে।।করযোড়ে শিশু তবে বলয়ে বচন।তোমার ঔরসে জন্ম, তোমার নন্দন।।এত শুনি পুত্রে চন্দ্র করিল চুম্বন।কোলে করি নিজ গৃহে লইল নন্দন।।বুধ বলি নাম তার ঘোষয়ে জগতে।তাহারে লইয়া চন্দ্র গেল সুস্থচিত্তে।।সত্যলোকে প্রজাপতি করিল গমন।খণ্ডন না যায় প্রভু চন্দ্রের বচন।।নীলধ্বজ-গৃহে কন্যা আসি জন্ম নিল।চন্দ্রাবতী নাম তার নৃপতি রাখিল।।মহাভারতের কথা অমৃত লহরী।কাশী কহে, শ্রবণেতে তরে ভববারি।।৩৪. চান্দ্রায়ণ ব্রত উপলক্ষে চন্দ্রকেতু রাজার উপাখ্যানভীষ্ম বলিলেন রাজা করহ শ্রবণ।আর কিছু ব্রত কথা কহিব এখন।।চান্দ্রায়ণ মহাব্রত বিখ্যাত সংসারে।শ্রদ্ধাভক্তি করি ব্রত যে জন আচরে।।সর্ব্বকাম ফল লভে নাহিক সংশয়।পূর্ব্বে কহিয়াছি আমি এ সব নির্ণয়।।এক ইতিহাস কহি শুন দিয়া মন।পূর্ব্বে চন্দ্রকেতু রাজা ইক্ষ্বাকুনন্দন।।চন্দ্রের নন্দিনী সেই পতিব্রতা সতী।চন্দ্রাবতী নামে কন্যা তাহার যুবতী।।শাপ হেতু জন্ম নিল নীলধ্বজ ঘরে।চন্দ্রাবতী নাথ হৈল বিখ্যাত সংসারে।।এত শুনি জিজ্ঞাসেন ধর্ম্মের নন্দন।কহ শুনি পিতামহ ইহার কারণ।।চন্দ্রের সে নন্দিনীকে শাপে কোন্ জন।মর্ত্ত্যলোকে তাহার জনম কি কারণ।।ভীষ্ম বলিলেন রাজ্য কর অবধান।পড়িবারে যান চন্দ্র বৃহস্পতি স্থান।।সর্ব্বশাস্ত্রে সিদ্ধ দ্বিজ অঙ্গিরা তনয়।নানা শাস্ত্র চন্দ্রকে পড়ান অতিশয়।।জীবের রমনী যেই তারকা নামেতে।মোহিত হইল চন্দ্র তাহার রূপেতে।।কামে বশ হয়ে গুরুপত্না না মানিল।প্রবন্ধ মায়ায় তারে হরিয়া লইল।।তারারে লইয়া গেল আপন ভব্ন।চিরকাল তারা সহ করিল রমণ।।মর্ত্ত্যলোকে গিয়াছিল গুরু বৃহস্পতি।যজ্ঞ সাঙ্গ করিয়া আইল মহামতি।।পরলোক স্থানে শুনি এ সব কথন।গুরুপত্নী সুধাকর করিল হরণ।।ক্রুদ্ধ হয়ে গেল গুরু চন্দ্রের সদন।বলিল পাপিষ্ঠ তুই বড়ই দুর্জ্জন।।বৃথা শাস্ত্র মম স্থানে করিলা পঠন।গুরুপত্নী হরি পাপ করিলা অর্জ্জন।।গুরুগর্ব্ব নাহি দেখ আপন অপায়।আজি হৈতে হইবে কলঙ্ক তব গায়।।তবে আর মম বাক্য শুনরে অধম।মম শাপে মর্ত্তলোকে হইবে জনম।।কুরুবংশে ধনঞ্জয় পাণ্ডুর কুমার।তাহার ঔরসে জন্ম হইবে তোমার।।কৃষ্ণের ভাগিনা হয়ে সুভদ্রা গর্ভেতে।অল্প দিনে শাপ মুক্ত হইবে তাহাতে।।এত শুনি চন্দ্রে তবে হৈল ক্রুদ্ধমন।বৃহস্পতি গুরুরে শাপিল সেইক্ষণ।।নিজ বশ নয় আত্মা পরবশ হয়।জানিয়া আমারে শাপ দিলা মহাশয়।।তোমারে ত শাপ আমি দিব সে কারণ।হীন পক্ষীযোনি মধ্যে পাইয়া জনম।।গৃধিনী নামেতে পক্ষী অবশ্য হইবা।চিরদিন ভোগ ভুঞ্জি শাপে মুক্ত হবা।।এত শুনি জিজ্ঞাসেন ধর্ম্ম নরপতি।কিরূপেতে পক্ষীযোনি পায় বৃহস্পতি।।কতদিনে গত হৈল শাপ বিমোচন।কহ শুনি পিতামহ ইহার কারণ।।গাঙ্গেয় বলেন ভূপ করহ শ্রবণ।চন্দ্রের বচন কভু না যায় খণ্ডন।।গৃধ্র পতগেতে জন্ম হৈল বৃহস্পতি।বৃন্দারক গিরিতটে করিল বসতি।।পরম কৌতুকে রহে ভার্য্যার সংহতি।কত দিনে পক্ষিণী হইল গর্ভবতী।।চারিগুটি ডিম্ব কত দিনে প্রসবিল।ডিম্ব ফুটি চারি শিশু তাহাতে জন্মিল।।দুই গুটি ডিম্বে হৈল দুই গুটি সুতা।স্বামী সহ পক্ষিণী হইল আনন্দিতা।।সর্ব্বাঙ্গ সুন্দর শিশু দেখি চারিজন।বাৎসল্য ভাবেতে দোঁহে করিল পালন।।ক্ষণেক না ছাড়ে দোঁহে শিশুর সংহতি।নানা উপহার ভোগে পালে নীতি নীতি।।এইরূপে কত দিন আনন্দ কৌতুকে।ভার্য্যা পত্নী সহ পক্ষী বঞ্চে নানাসুখে।।একদিন দৈববশে তাহার কারণ।একেশ্বর সে পক্ষী চলিল ঘোর বন।।ভার্য্যারে রাখিয়া ঘরে শিশুর রক্ষণে।আহার কারণে গেল দণ্ডক কাননে।।হেনকালে এক ব্যাধ আইল সেখান।পক্ষীরে দেখিয়া অন্ত্র করিল সন্ধান।।অল্পমাত্র অন্ত্র হইল শরীরে।উড়িয়া পড়িল পক্ষী রেবানদী তীরে।।শূন্য এক দেবালয় ছিল সেই স্থলে।তাহার ভিতরে গেল ক্ষতে অঙ্গ জ্বলে।।পশ্চাতে দেখিয়া ব্যাধ আইল সত্বর।ত্বরাত্বরি প্রবেশিল মন্দির ভিতর।।বাণেতে পীড়িত পক্ষী উড়িবারে নারে।ফিরি ফিরি চলে পক্ষী ধরিতে না পারে।।সাতবার প্রদক্ষিণ কৈল দেবালয়।তবে মহাক্রুদ্ধ ব্যাধ হৈল অতিশয়।।পুনরপি দিব্য অস্ত্র করিল প্রহার।বাণাঘাত তনুত্যাগ হইল তাহার।।পক্ষী লয়ে গৃহে ব্যাধ গেল হৃষ্টচিত্তে।বিষ্ণু প্রদক্ষিণ ফল লফিল তাহাতে।।সেই পুণ্যে শাপে মুক্ত হৈল সেইক্ষণ।দিব্যমূর্ত্তি হইয়া চলিল নিকেতন।।যাহা জিজ্ঞাসিল রাজা কহিনু তোমারে।শুরু শিষ্য দোঁহে শাপ দিলেন দোঁহারে।।গর্ভবতী ভার্য্যা তবে দেখি বৃহস্পতি।ক্রুদ্ধচিত্তে তাহারে বলয়ে মহামতি।।অবলা স্ত্রীজাতি তুমি কি বলিব আর।মম বাক্যে এই গর্ভ করহ সংহার।।তবে সে লইব তোমা আপন ভবনে।শীঘ্রগতি গর্ভ ত্যাগ এর এইক্ষণে।।ভয়েতে আকুল প্রসবিল সেইক্ষণ।এক গুটি সুতা হৈল একটি নন্দন।।দেখি হরষিত জীব কহেন তখন।মম কন্যা পুত্র এই বিধির সৃজন।।চন্দ্র বলে মম পুত্র কন্যা এ হইল।আমার ঔরসে জন্ম জানয়ে সকল।।কথায় কথায় দ্বন্দ্ব হয় দুই জন।জানিয়া সকল তত্ত্ব দেব পদ্মাসন।।শীঘ্রগতি সেই স্থলে করিল গমন।দ্বন্দ্ব নিবারণ হেতু কহেন বচন।।আমার বচনে দ্বন্দ্ব কর নিবারণ।এই কন্যা পুত্রেরে জিজ্ঞাস বিবরণ।।যাহার ঔরসে জন্ম কহিবে কাহিনী।এত শুনি জিজ্ঞাসা করিল নিশামণি।।নন্দিনী কহিল দেব কর অবধান।যার ক্ষেত্র তার পুত্র শাস্ত্রের বিধান।।এত শুনি ক্রোধেতে বলিল শশধর।মম শাপে নরলোকে হও লোকান্তর।।নরলোক গিয়া জন্ম লভহ পাপিনী।নীলধ্বজ ঔরসেতে জন্মিবে নন্দিনী।।সেইক্ষণে লোকান্তর হইল তাহার।তবে চন্দ্র জিজ্ঞাসিল চাহিয়া কুমার।।কহ সত্য জন্ম তব কাহার ঔরসে।মিথ্যা না কহিবা সত্য কহিবা বিশেষে।।এত শুনি করযোড়ে বলয়ে বচন।তোমারে ঔরসে জন্ম তোমার নন্দন।।এত শুনি পুত্রে চন্দ্র করিল চুম্বন।কোলে করি নিজ গৃহে লইল নন্দন।।বুধ বলে নাম তার ঘোষয়ে জগতে।তারারে লইয়া গুরু গেল ধৈর্য্য চিতে।।সত্যলোকে প্রজাপতি করিল গমন।খণ্ডন না যায় কভু চন্দ্রের বচন।।মহাভারতের কথা অমৃত লহরী।কাশী কহে শুনিলে তরযে ভববারি।।৩৫. চন্দ্রকেতু রাজার মৃত্যু৩৫. চন্দ্রকেতু রাজার মৃত্যুভীষ্মদেব বলিলেন শুন নরপতি।কতদিনে যুবতী হইল চন্দ্রাবতী।।ভুবনে বিখ্যাত নীলধ্বজ নরবর।কন্যার যৌবন দেখি দিল স্বরন্বর।।পৃথিবীর রাজগণে ধরিয়া আনিল।ইন্দ্রের সমান সভা শোভিত হইল।।একে একে কন্যা নিরখিল রাজগণে।চন্দ্রকেতু ভূপে দেখি পীড়িত মদনে।।গলে মাল্য দিয়া তারে করিল বরণ।কন্যা লয়ে গেল রাজা আপন ভবন।।গুণে মহাগুণী রাজা প্রতাপে তপন।শীলতায় চন্দ্র যেন তেজে বৈশ্রবণ।।এক ভার্য্যা বিনে রাজা অন্য নাহি জানে।উর্ব্বশী সহিত যেন বুধের নন্দনে।।চান্দ্রায়ণ মহাব্রত আচরে নৃপতি।নিরাহারে একমাস ভার্য্যার সংহতি।।যেই দিন হৈতে ব্রত সাঙ্গ সমাধান।সেই দিনে চন্দ্রাবতী করে ঋতুস্নান।।চন্দ্রাবতী রূপে দীপ্তি মোহে ত্রিভুবন।দেখিয়া নৃপতি মন পীড়িল মদন।।ব্রত ভঙ্গ করি রাজা করিল রমণ।বহুমতে চন্দ্রাবতী করিল বারণ।।কামে বশ হয়ে রাজা না শুনিল বাণী।সেই পাপে পঞ্চত্ব পাইল নৃপমণি।।স্বামীর মরণে কন্যা কান্দিল অপার।ধর্ম্মকেতু নামে তার হইল কুমার।।পাত্র মিত্রগণ কত করিয়া যুকতি।রাজদণ্ড দিয়া তারে করিল নৃপতি।।ভীষ্ম বলিলেন শুন ধর্ম্মের নন্দন।চন্দ্রকেতু রাজা যদি ত্যজিল জীবন।।দুই যমদূত আসি করিল বন্ধন।চন্দ্রকেতু নৃপে নিল যমের ভবন।।কপট করিয়া যম জিজ্ঞাসিল তারে।তোমা সম নাহি কেহ ধার্ম্মিক সংসারে।।কিছুমাত্র অল্প পাপ আছয়ে তোমার।ব্রতসাঙ্গ দিনে তুমি করিলে শৃঙ্গার।।এত শুনি বলে রাজা ভাবি নিজ চিত্তে।অল্প পাপ থাকে যদি ভূঞ্জিব অগ্রেতে।।ধর্ম্মরাজ বলে জন্ম গৃধ্রের যোনিতে।হীনপক্ষী হয়ে থাক কৌণ্ডিণ্য পুরেতে।।গৃধ্র পক্ষী হয়ে জন্ম লইল রাজন।চন্দ্রাবতী শুনিলেক এ সব কথন।।পিতার বাড়ীতে কন্যা গেল দুঃখী মন।জনকেরে কহিল এ সব বিবরণ।।শুনি নীলধ্বজ রাজা হৈল সচিন্তিত।যুক্তি কৈল রাজ পুরোহিতের সহিত।।যুক্তি করি চাহি তবে বলিল কন্যারে।স্বরম্বর করি পুনঃ বর অন্য বরে।।কন্যা বলে হেন বাক্য না বলিহ আর।আপনার দেহ আমি করিব সংহার।।কৌণ্ডিন্য নগরে যদি না পাঠাও মোরে।নারীহত্যা দিব তবে তোমার উপরে।।শুনি রাজা ভৃত্যগণ দিলেন সংহতি।কৌণ্ডিন্য নগরে পুনঃ গেল চন্দ্রাবতী।।শকুনির রূপ কন্যা দেখিয়া স্বামীরে।বিলাপ করিয়া কাঁদে অনেক প্রকারে।।ক্রন্দন নিবর্ত্তি তবে বলয়ে বচন।কি কারণে ব্রত ভঙ্গ করিলে রাজন।।তার ফল ভুঞ্জ তুমি না হয় এড়ান।কেমনে তোমারে আমি পাব মতিমান।।ধর্ম্মরাজ করিলেন হেন তব গতি।আজি আমি শাপ দিব ধর্ম্মরাজ প্রতি।।এতেক বলিয়া জল লইলেক হাতে।শাপভয়ে ধর্ম্ম তথা আসিল সাক্ষাতে।।করযোড়ে কন্যা প্রতি বলয়ে বচন।আমারে শাপিতে মাতা চাহ কি কারণ।।তব স্বামী চন্দ্রকেতু হেন হৈল মন।ব্রত সাঙ্গ দিনে তোমা করিল রমণ।।সে কারণে হইল কলুষ অতিশয়।যাহা করি তাহা ভূঞ্জি নাহিক সংশয়।।আমার বচনে কোপ কর নিবারণ।পাপে মুক্ত তব স্বামী হইবে এখন।।গৃধ্রমুর্ত্তি ত্যজি পুনঃ দিব্যমূর্ত্তি হবে।নাহিক সংশয় আজি স্বামীকে পাইবে।।এতেক বলিতে স্বর্গে দুন্দুতি বাজিল।শকুনির রূপ ত্যজি দিব্যমূর্ত্তি হৈল।।দেবীর আকৃতি হৈল কন্যা চন্দ্রাবতী।দেবরথ পাঠাইল দেব শচীপতি।।রথে চড়ি স্বর্গে দোঁহে করিল গমন।কহিনু পুরাণ কথা ধর্ম্মের নন্দন।।চন্দ্রকেতু উপাখ্যান শুনে যেই জন।সর্ব্বপাপে মুক্ত হয় ব্যাসের বচন।মহাভারতের কথা অমৃত সমান।কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান।।
Subscribe to:
Posts (Atom)
ConversionConversion EmoticonEmoticon